Friday, June 20, 2014

বাংলা বানান বিভ্রাট-- বিভ্রাট বানানে?


বাংলা বানান বিভ্রাট-- বিভ্রাট বানানে?

বাংলা ইউনিকোড ফন্ট ডাউনলোড করুন

অহনলিপি-বাংলা১৪ AhanLipi-Bangla14
https://sites.google.com/site/ahanlipi/font-download/AhanLipi-Bangla14.zip


বাংলা বানান বিভ্রাট-- বিভ্রাট বানানে?


 'পুঁথি ও পত্র' ষাণ্মাসিক৤১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, 
২৫বৈশাখ ১৪২১ --প্রকাশিত




বাংলা বানান বিভ্রাট-- বিভ্রাট বানানে?

মনোজকুমার দ. গিরিশ





       বাংলায় কিছু লিখতে গেলে আমাদের ভয় করে, কারণ তার বানান টলমল৤ কোন্ শব্দের যে কী বানান হবে তা নিয়ে সব সময়েই দোলাচল৤ একটি বুধসভায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই মতবিরোধ দেখা গেছে "চিন" বানানটি নিয়ে৤ শব্দটির বানান নিয়ে সেখানেও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি৤ তাঁরাই যদি ঠিক করতে না পারেন যে চিন বানান-- চীন হবে নাকি চিন, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের যে কি অবস্থা তা আর বলার নয়৤ মনে হতে পারে যে অভিধান দেখে নিলেই তো হয়? না, পদে পদে অভিধান দেখা সম্ভব নয়৤ আর যদি যেমন-তেমন করে বানান লিখে পরে প্রতিটি শব্দ ধরে বানান ঠিক করে নেওয়া যায় তবে হয়তো নিশ্চিত হওয়া যাবে যে এবার সব ঠিক হয়েছে৤ কিন্তু অরুণ সেন যা বলেছেন তা শোনা যাক, "যে-শব্দকে কোনো অভিধানে তৎসম বলা হয়েছে, সেই শব্দকেই হয়তো অন্য অভিধানে তদ্ভব বা এমনকী কখনো বিদেশী বলে গণ্য করা হয়েছে" পৃঃ-৫২৤

(বাংলা বানান ও বিকল্প বর্জন একটি প্রস্তাব-- অরুণ সেন৤ প্রতিক্ষণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৩)৤ 

তাহলে উপায় কী? বিভিন্ন অভিধানেই যদি বিভিন্ন বানান থাকে-- তা বিভিন্ন উৎস থেকে আসার জন্য, তবে তো চিত্তির৤ আর শুধু অভিধান? প্রত্যেক পণ্ডিত ব্যক্তি, প্রত্যেক শিক্ষিত লোকেরই নিজ নিজ বানান-ধারণা আছে, অবশ্যই যা পরস্পর পৃথক৤ ফলে সকল শব্দের সকল বানানই যে কখনও ঠিক করে লেখা যাবে তা বলা কঠিন৤ 


       বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে উদ্যোগ কিন্তু কম নেওয়া হয়নি, কিন্তু এখন অবধি কোনও সত্যি সুরাহা হয়নি৤ বহুবার বহু প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বাংলা বানান সংস্কারের জন্য, তার তালিকা এমনি--

১৯২৫-- চল্‌তি ভাষার বানান, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় [প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩৩২, নভেম্বর ১৯২৫-এ প্রকাশিত৤ নীতি নির্ধারক ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দেখে দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অনুমোদন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]



এর প্রায় এক দশক পরে--

১৯৩৬-৩৭-- বাংলা বানানের নিয়ম, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


          [৮মে, ১৯৩৬, ১ম সংস্করণ 
          ২অক্টোবর, ১৯৩৬, ২য়সংস্করণ 
         ২০মে, ১৯৩৭,  ৩য় সংস্করণ ]



এর প্রায় দেড় দশক পরে--

১৯৪৯-- পূর্ববঙ্গ সরকারী ভাষা কমিটি সোপারেশ [সভাপতি, সৈয়দ আলী আহ্‌সান] (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ -- সদস্য)
শুরু ৯ মার্চ,১৯৪৯, এবং শেষ ৭ডিসেম্বর ১৯৫০৤



এর তিন দশক পরে--

১৯৭৯-- বাংলা বানানের নিয়ম, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (আবার)৤[সভাপতি অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়]



এর দেড় দশক পরে--

 ১৯৯২-- বাংলা একাডেমী, ঢাকা



এর পাঁচ বছর পরে--

১৯৯৭-- বাংলা বানানবিধি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি [জানুয়ারি, ১৯৯৭]


অন্যান্য---
১৮৫৫-- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [বর্ণপরিচয়] বর্ণমালার ব্যাপক সংস্কার (১লা বৈশাখ, সংবৎ ১৯১২, ১৩ এপ্রিল, ১৮৫৫)৤ 
১৯৭৮-- বাংলা বানান সংস্কার, জগন্নাথ চক্রবর্তী [দেশ,১১মার্চ, ১৯৭৮]
১৯৮১-- প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক(কিশলয়) [মার্চ, ১৯৮১] অন্তঃস্থ-ব(ৱ) বর্জন৤
১৯৯১-- আনন্দবাজার পত্রিকা৤

       বছরের ক্রমানুসারে সাজালে বানান-সংস্কার তালিকা হবে এমনি--
১৮৫৫ -বিদ্যাসাগর
১৯২৫ -- বিশ্বভারতী
১৯৩৬-৩৭ -- কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪৯ -- পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি
১৯৭৮ -- জগন্নাথ চক্রবর্তী
১৯৭৯ -- কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় [আবার]৤ সম্পূর্ণ হয়নি
১৯৮১ -- প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক(পঃবঃ সরকার)
১৯৯১ -- আঃবাঃ পত্রিকা
১৯৯২ -- বাংলা একাডেমী, ঢাকা
১৯৯৭ -- পঃবঃ বাংলা আকাদেমি 

       কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু বানান সংস্কার তৃতীয় সংস্করণ অবধি প্রকাশ করছে, তাই একুনে ১২টি সংস্কার হয়েছে৤ ফল? শূন্য না হলেও অপ্রতুল৤ কারণ যদি কোন একটি কাগজে নিজের অভিমত কিছু প্রকাশ করতে চাই তবে সেই বিশেষ কাগজটি কী বানান অনুসরণ করে তা দেখে সেই অনুযায়ী বানানে লিখে চিঠি পাঠাতে হবে৤ আর যদি তা নাও করা হয়, তবে কাগজের সম্পাদকীয় দপ্তর লেখাটির বানান নিজেদের মতো করে ঠিক করে নেবে৤ বিজ্ঞাপনে 'হীরে' চলতে পারে, চিঠিতে চলবে না, চিঠিতে 'হিরে' হবে৤ আমরা 'হীরে' কিনব আর 'হিরে' লিখব৤

       ভাষা এবং বানান হল একটি অলিখিত সামাজিক রীতি, তা সবার সাথে সমমতে না চললে সংস্কৃতির সংকট কাটে না৤ আমি একরকম বানানে লিখলাম আর কাগজটি তা নিজেদের মতো করে নিলে আমার মনে এবং মানে বাধবে৤ আর তা রোধ করতে চাইলে একটি নির্দিষ্ট কাগজের গোষ্ঠীভুক্ত থাকাই ঠিক হবে৤ অন্তত সেই সামাজিক সীমিত পরিধির মধ্যে সকলে বানান নিয়ে এক মত বলে৤ এই যে বানান ঘরানা তা যেন সংগীত ঘরানার মতো৤ বাংলা বানান নিয়ে বাংলাভাষীরা সকলে এক মত হতে যেন রাজি নয়৤ তাহলে আমার আমিত্ব কমে যাবার ভয়, লোকে আমাকে কম পণ্ডিত মনে করবে৤ সেটা সওয়া বেশ কঠিন৤ আর সইতে যাবই-বা কেন? বানানে অবাধ না হলেও অনেকটাই স্বাধীনতা আছে যে! একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে৤ খ্যাত একজন কম্পিউটার ফন্ট নির্মাতার কাছে গেছি, তিনি নানা আলোচনার মধ্যে এক সময়ে ফন্টের রূপারোপের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানালেন, একবার একজন ওডিয়াভাষী মানুষ তাঁদের ফন্টের গঠন বিষয়ে আলোচনা করতে এসে কথা প্রসঙ্গে জানালেন যে, তাঁদের একটি হরফের রূপ কিছুটা পালটে চালু করা হয়েছে৤ এতে সেই ফন্ট বিশেষজ্ঞ বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, সেকী এ নিয়ে বিরোধ হয়নি? জবাবে সেই ওডিয়াভাষী যা বললেন তা প্রণিধানযোগ্য৤ তিনি বললেন, আমাদের তো অনেক বিদ্যাসাগর নেই৤ 

      বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে বাঙালির সমস্যা বোধ হয় অনেক বিদ্যাসাগর থাকা৤ 

      অরুণ সেনের কথা আবার শোনা যাক--
বাংলা ভাষায় লেখালেখি, পড়া ও পড়ানো, বই বা পত্রপত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনা কিংবা প্রুফ-দেখার কাজ, ইত্যাদিতে যাদের জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে, তাদের বহু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি অন্তত এই: বাংলা বানান নিয়ে যথেচ্ছাচার কত রকমের এবং কত গভীর হতে পারে তা চাক্ষুষ করা৤ ... অনেকেই মনে করে, "বাংলা বানান তো সব রকমই হয়৤"(ঐ, পৃঃ-১৭)৤ 

       এ কথার প্রেক্ষিতে মনে হয়, বিভ্রাট বাংলা বানানে, নাকি আমাদের মনে, মানসিকতায়? আমরা কেউ কাউকে মানব না, কোনও মান্য প্রতিষ্ঠানকেও না, কারও পান্ডিত্যে আস্থা রাখব না, নিজের সুবিধে মতো বাংলায় বানান লিখব৤ ফলে বানানটা আর আমাদের মতো সাধারণ লোকের শেখা হয়ে উঠল না৤ আজ এই বানান তো কাল অন্য বানান৤ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে জ-এর তলায় বিন্দু দিয়ে ইংরেজি জেড বোঝানো হচ্ছে৤ ইংরেজি ধ্বনিকে নিখুঁতভাবে বোঝানোর জন্য এটা করা হচ্ছে৤ কিন্তু আবার বাংলা বানানে "ষ" থাকছে, বাংলায় কি "ষ" আছে আদৌ? বাংলার ধ্বনিচিত্রের দিকে না তাকিয়ে বা নজর না দিয়ে অন্যত্র নজর দেওয়ায় নতুন সংকট হবে না তো? যেমন হয়েছে বাংলায় সংস্কৃত বানান হুবহু চালানোর ফলে৤  

       কেন এসব হচ্ছে তা বোঝা কঠিন৤ খানিকটা সুবিধাভোগীর মতো-- 'এ্যাও হয় অও হয়' গোছের ব্যাপার হয়ে থাকছে সবটা৤ তাই একথা জোর করেই বলা যায় যে, পৃথিবীতে এমন কোনও লোক নেই যার বাংলা বানান সবটাই ঠিক৻ কারণটা সহজ-- অন্য বানানগোষ্ঠীর লোক বলবেন যে, এ বানানটা ঠিক হয়নি, এটা এমনি না হয়ে অমনি হবে৤ আর গোষ্ঠী তো অঢেল৤ কাগজে কাগজে, সংস্থায় সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে, ব্যক্তিতে-- একক বা বহুজনমিলে গোষ্ঠী৤ সবার কাছে পাশ কিন্তু কেউই নয়৤ তাই বাংলা বানান ফেল! 

       ইংরেজিতে একটি শব্দের একটিই বানান, সারা পৃথিবী জুড়েই তা এক বানান, কোনও দ্বৈতভাব নেই৤ অবশ্য 'সারা পৃথিবী জুড়ে' কথাটা ঠিক নয়, আমেরিকা তার নিজস্ব স্টাইলে কিছু ইংরেজি বানান লেখে যা ইংলন্ডের বানানের সঙ্গে মেলে না(colour--color)৤ সেটা ব্যতিক্রমই, তা মোটেই বাংলা বানানের মতো যথেচ্ছ নয়৤ 

       বাংলা বানানের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি হল, বানানে একক রীতি না নেওয়া৤ বাংলা বানানে নীতি হচ্ছে সংস্কৃতের বানান এই, অন্য শব্দের বানান এই, দেশি শব্দের বানান এই৤ এসব করে এক কালে গভর্নমেন্ট লেখা হত "গভর্ণমেন্ট"৤ 'চিন' তো এখনও অচেনাই রয়ে গেল৤ "সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের বানানে যে রক্ষণশীলতা তা কিন্তু চিরকালের৤ সেই ভাষার বহু চিহ্নই অনেকাংশে তাদের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে ঠিকই, সংস্কৃত চর্চাও প্রায় বিলুপ্তির পথে, তবু তৎসম শব্দের চেহারা সেই চিহ্নসহ এমন গেঁথে আছে লোকস্মৃতিতে যে তাকে 'বৈজ্ঞানিক' বুদ্ধিতে লোপ করার চেষ্টা করলে বাঙালির মনোজগতের শৃঙ্খলাকেই ব্যাহত করা হবে৤ বাংলা ভাষার তৎসম শব্দের এই 'অবৈজ্ঞানিক' বানানই এখন বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গ"(ঐ, পৃঃ-১৯)৤ 

       "তাকে 'বৈজ্ঞানিক' বুদ্ধিতে লোপ করার চেষ্টা করলে বাঙালির মনোজগতের শৃঙ্খলাকেই ব্যাহত করা হবে" বললেও 'বৈজ্ঞানিক' বুদ্ধি বাদ দিয়েও তো সেই শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না৤ যদি সেটা করা যেত তবে নাহয় 'অবৈজ্ঞানিক' হতে বাধা ছিল না৤ তিনি আবার এটাও বলেছেন যে, "পৃথিবীর সব ভাষাতেই মৌলিক এবং আগন্তুক ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে৤ কিন্তু বাংলা ভাষার ইতিহাসে যেভাবে ঘটেছে তা অন্যত্র বোধহয় তুলনীয় নয়৤ তাই এখানে বানানের যে জটিলতা তা এই ইতিহাসের কারণেই এবং তা এই ভাষার নিজস্ব৤ এর সমাধানও হবে এই নিজস্বতাকে মেনে নিয়ে"(ঐ, পৃঃ-১৯)৤ এই নিজস্বতা কী হবে? একটা স্পষ্ট এবং ঋজু পথ চাই, যা মেনে এই জটিল এবং কুটিল সমস্যা মিটবে৤ বাংলাভাষা বাংলা না হয়ে বেশি করে সংস্কৃতমুখী হলে কি সমস্যা মিটবে, নাকি তা বাড়বে? হয়তো বাড়বেই, কারণ বাংলা উচ্চারণ, বর্ণধ্বনি সংস্কৃতের মতো নয়, যদিও বাংলা বর্ণমালা সংস্কৃত থেকেই নেওয়া, কিন্তু দুটি ভাষার ধ্বনি চরিত্রে বিশাল তফাৎ হয়ে গেছে৤ তাই বাংলা বানান সংস্কৃত অনুসারী করলে বানানে বিভ্রাট অবধারিত৤ তাই বাংলাদেশে লেখা হয়-- হযরত, আর পঃবঙ্গে লেখা হয়-- হজরত৤ এরকম অনেক পার্থক্যই আছে৤ দেখেছি ক্রিকেট লেখা হয় কৃকেট৤ একটা নির্দিষ্ট পথ, বা নীতি তথা নির্দিষ্ট বানান অনুসরণ না করলে এর সুরাহা হবে না৤   

       বাংলায় আছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ তার সবটার বানান মনে রাখা সম্ভব নয়৤ আর সম্ভব নয় বলেই অভিধান থাকে৤ অভিধান থেকে শব্দের অর্থ এবং বানান দুটোই পাওয়া যায়৤ দেখা যায় একই শব্দের একাধিক বানানও চলে, ফলে শব্দের সংখ্যা আরও বেশি হবে৤ সংস্কৃত পণ্ডিতেরা যদিওবা সংস্কৃত বানান মেনে চলতে পারেন অন্যেরা তা পারবেন না, সাধারণ মানুষেরা তো নয়ই৤ "চৈতন্য [চৈতন্য ১৪৮৬-১৫৩৩, আয়ু ৪৮ বছর] সাহিত্য বাংলাভাষায় যে কেবল জীবনচরিত লেখার প্রবর্তন করল, তা-ই নয়, ভাষার ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা বানানেও সর্বপ্রথম বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করতে লাগল৤ এর প্রধান কারণ এই যে, চৈতন্যচরিতকারের সকলেই সংস্কৃত ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন৤ সে জন্য বিশুদ্ধ সংস্কৃতশব্দের ব্যাপক ব্যবহার ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাদের যত্ন ও চেষ্টা স্বাভাবিক৤ এভাবে ভারতচন্দ্র রায়ের[১৭১২-৬০ আয়ু ৪৯ বছর] আবির্ভাবের পূর্বেই সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা বাংলাভাষায় বিশেষভাবেই বিস্তৃতি লাভ করেছিল"(পৃঃ-৮৮)৤ (বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠসমীক্ষা-- মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বাংলা একাডেমী:ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি-১৯৮৪)। 

       ইংরেজ আমলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রভাবে বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতায়ন ঘটেছে প্রবল রকম৤ ফলে বাংলায় সংস্কৃত শব্দ বেড়েছ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও  বেড়েছে৤ তা হলে কি সংস্কৃত শব্দগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে? সেরকম করলে তো ভাষা দরিদ্র হয়ে পড়বে, বানানের বাড়ি বাঁচাতে গিয়ে খোদ মালিকই দরিদ্র হয়ে পড়লে চলবে কেন? "অনেকের বিশ্বাস:বাংলাভাষায় বানানসমস্যা বোধ হয় আধুনিক সৃষ্টি প্রাচীনকালে এমনটি ছিল না; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়৤ বর্তমানের তুলনায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় এই সমস্যা সকল প্রকারেই জটিল ছিল" [ঐ, পৃঃ-৮৭]৤

       মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(১৮৫১-১৯৩১, আয়ু ৮০ বছর) যা বলেছেন তা শোনা যাক--"যাঁহারা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই৤ হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন৤ কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন৤ নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কী আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজরও পড়ে নাই৤ 

         এখন তাঁহাদের বই পড়িয়া যাঁহারা বাংলা শিখিয়াছেন,তাঁহাদের যথার্থ মাতৃভাষায় জ্ঞান সুদূরপরাহত হইয়াছে৤ অথচ ইঁহারাই যখন লেখনী ধারণ করেন, তখন মনে করেন যে, আমার বাংলা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট৤ 

          সকলেই জানেন অতি অল্পদিন পূর্বে বাংলা ভাষায় গদ্যগ্রন্থ ছিল না, কিন্তু পদ্য প্রচুর ছিল৤ ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ হইবার পূর্বে যেসকল পদ্য লিখিত হইয়াছিল, তাহা বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় লিখিত৤ ... গদ্য না থাকিলেও ভদ্র সমাজে যে ভাষা প্রচলিত থাকে তাহাকেই বিশুদ্ধ বাংলাভাষা কহে৤ আমাদের দেশে সেকালে ভদ্রসমাজে তিন প্রকার বাংলাভাষা চলিত ছিল৤ মুসলমান নবাব ও ওমরাহদিগের সহিত যে-সকল ভদ্রলোকের ব্যবহার করিতে হইত, তাঁহাদের বাংলায় অনেক উর্দু শব্দ মিশানো থাকিত৤ যাঁহারা শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহাদের ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হইত৤...মোটামুটি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, বিষয়ী লোক, ও আদালতের লোক এই তিন দল লোকের তিন রকম বাংলা ছিল৤ 

        ইংরেজরা এ দেশ দখল করিয়া ভাষার কিছুমাত্র পরিবর্তন করিতে পারেন নাই৤কিন্তু তাঁহারা বহু-সংখ্যক আদালত স্থাপন করায় এবং আদালতে উর্দুভাষা প্রচলিত রাখায় বাংলাময় পারসি শব্দের কিছু অধিক প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল মাত্র৤ সাহেবরা পারসি শিখিতেন, বাংলা শিখিতেন৤ দেশীয়রা দেশীয় ভাষায় তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেন৤ সুতরাং ইংরেজি কথা বাংলার মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পারে নাই৤ যাঁহারা ইংরেজি শিখিতেন বা  ইংরেজের  সহিত  অধিক মিশিতেন দেশের মধ্যে প্রায়ই তাঁহাদের কিছুমাত্র প্রভুত্ব থাকিত না৤ ...আমাদিগের দুর্ভাগ্যক্রমে যে সময়ে ইংরেজ মহাপুরুষেরা বাঙালিদিগকে বাংলা শিখাইবার জন্য উদ্যোগী হইলেন, সেই সময়ে যে-সকল পণ্ডিতের সহিত তাঁহাদের আলাপ ছিল তাঁহারা সংস্কৃত কালেজের ছাত্র৤ তখন সংস্কৃত কালেজ বাংলায় একঘরে৤ ...হঠাৎ তাঁহাদিগের উপর বাংলা পুস্তক প্রণয়নের ভার হইল৤ তাঁহারাও পণ্ডিতস্বভাবসুলভ দাম্ভিকতা সহকারে বিষয়ের গুরুত্ব কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন৤ ...রাশি রাশি সংস্কৃত শব্দ বিভক্তি পরিবর্জিত হইয়া বাংলা অক্ষরে উত্তম কাগজে উত্তমরূপে মুদ্রিত হইয়া পুস্তকমধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল৤ ... এই শ্রেণীর লেখকদের হস্তে বাংলাভাষার উন্নতির ভার অর্পিত হইল৤ লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের দুর্বোধ্য দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল৤ অথচ এডুকেশন ডেস্‌প্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল৤ বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল৤... তাঁহারা বরফের পরিবর্তে তুষার, ফোয়ারার পরিবর্তে প্রস্রবণ, ঘূর্ণির পরিবর্তে আবর্ত, গ্রীষ্মের পরিবর্তে নিদাঘ প্রভৃতি আভাঙা সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়া, গ্রন্থের গৌরব রক্ষা করিতেন৤ অনেক সময়ে তাঁহাদের ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ সংস্কৃতেও তত চলিত নহে, কেবল সংস্কৃত অভিধানে দেখিতে পাওয়া যায় মাত্র৤ এই সকল কারণ বশত, বলিয়াছিলাম যে, যাঁহারা বাংলা গ্রন্থ লিখিয়াছেন, তাঁহারা ভালো বাংলা শিখেন নাই৤ লিখিত বাংলা ও কথিত বাংলা এত তফাত হইয়া পড়িয়াছে যে, দুইটিকে এক ভাষা বলিয়াই বোধ হয় না৤ দেশের অধিকাংশ লোকেই লিখিত ভাষা বুঝিতে পারে না৤... গ্রন্থকারেরা বাংলাভাষা না শিখিয়া বাংলা লিখিতে বসিয়া এবং চলিত শব্দ সকল পরিত্যাগ করিয়া অপ্রচলিত শব্দের আশ্রয় লইয়া ভাষার যে অপকার করিয়াছেন, তাহার প্রতিকার করা শক্ত৤ ইংরেজির অতিরিক্ত চর্চা হওয়ায় বহু-সংখ্যক ইংরেজি শব্দ ও ভাব, বাংলাময় ছড়াইয়া পড়ায় বিষয়ী লোকের মধ্যে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, তাহার এত পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে যে, পূর্বে উহা কিরূপ ছিল তাহা আর নির্ণয় করিবার জো নাই৤ গ্রন্থকারদিগের বাংলা বাংলা নহে৤ বিশুদ্ধ বাংলা কী ছিল, তাহা জানিবার উপায় নাই৤"(বাংলা ভাষা, পৃঃ ৫৫৯-৫৬৭, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ৤ ডিসেম্বর, ১৯৮১)৤ 

ডঃ সুকুমার সেন কথাগুলি অস্বীকার করেননি বরং সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন৤ 

       তা হলে কী করণীয়? বাংলায় ই-ঈ/ি-ী আছে, সেসব কি তাহলে বাতিল করে সবটা একই রকম করতে হবে? অর্থাৎ বাংলায় কেবল 'ই' থাকবে, 'ঈ' থাকবে না, উ,ঊ/ু-ূ ; জ/য; ণ/ন; শ/ষ/স ইত্যাদির কেবল একটিই থাকবে, অন্যটি থাকবে না৤ তাহলে বানানে বিভ্রাট কমবে, এবং ক্রমে ভ্রান্তি সম্পূর্ণ লোপ পাবে৤ তেমন কথা তো ১৯৪৯-এ 'পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি' এবং ১৯৭৮-এ জগন্নাথ চক্রবর্তী বলে গেছেন৤ অনেক যুক্তি তর্ক তুলে ধরেছেন, কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি৤ যেন তা পাথরে কেবল কিল মারাই হয়েছে৤ জল একটুও নড়েনি৤ 

       বাংলা বানান নিয়ে এত যে মতান্তর, সেই জল না-নড়ার মূল কারণটি রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেছেন__ "একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না৤ কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি৤ ...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে৤ যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয়৤ মতের অনৈক্যে রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার৤... যাঁরা ইংরাজি শিখিয়া মানুষ হইয়াছেন, তাঁরা বাংলা শিখিয়া মানুষ হইবার প্রস্তাব শুনিলেই যে উদ্ধত হইয়া ওঠেন, মূলে তার অহংকার৤"(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বৈশাখ-১৩৯১ (১৯৮৪-এপ্রিল), বাংলা শব্দতত্ত্ব (তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ) কলকাতা৤ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ৤ পৃঃ১-২)৤  
 
       শব্দের বানান ধরে ধরে বানান সংস্কার করার উদ্যোগ নিলে সমস্যা কোনও কালেই মিটবে না, নজর দিতে হবে অন্য দিকে৤ যে-ধ্বনি বাংলায় আদৌ নেই তা ধরে রাখার প্রয়াস বন্ধ করলে বাংলা বানানের সমস্যা মিটবে৤ আর তার সবটা একবারেই সারতে চাইলেও চলবে না, তাতে ভাষাটা আর বাংলা বলে বোধ হবে না৤ একটু একটু করে ধৈর্য ধরে এগোতে হবে৤ বিন্দু বন্দু বারি সিঞ্চন করে ভাষাকে প্রাণ দিতে হবে, একবারে বন্যা বইয়ে দিলে হবে না, তাতে ভাষার মৃত্যু ঘটবে৤ আর তেমন চেষ্টাতেই ১৯৪৯-এর 'পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি'-র প্রয়াস এবং ১৯৭৮-এ জগন্নাথ চক্রবর্তীর করা প্রয়াস কোনও কাজে লাগেনি৤ আর বাকি অন্যসব উদ্যোগগুলি শব্দের বানান ধরে ধরে করার চেষ্টা হয়েছে, সেটা করলে কোনও কাজই এগোবে না৤ ঘাস ছেঁটে দিলে তা আপাতত বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হবে, কিন্তু দুদিন পরে তা আবার ফুটে বের হবে, শিকড়সুদ্ধ ঘাস উপড়ে ফেলতে হবে, তাহলে আর ঘাসের দৌরাত্ম্য থাকবে না৤

       কোথায় ভুলটা সবচেয়ে বেশি হয় তা আগে খুঁজে বের করতে হবে৤ সেই ভুলের জটই আগে কাটাবার উদ্যোগ নিতে হবে৤ তার পরে একটু একটু করে অন্য অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ ভুলের পিছনে ছুটতে হবে৤ ছোটো ভুল--বড়ো ভুল সবই একবারে তাড়াবার চেষ্টাতেই লোকে ভয় পেয়েছে৤ তেমন করলে ভাষাটা আর আদৌ বাংলা থাকবে তো?

    কোথায় ভুলটা সবচেয়ে বেশি তা খোঁজার তেমন কোনও প্রয়াস চোখে পড়েনি৤ বাংলা বানানে ভুলের বহরটা সবচেয়ে বেশি ই-ঈ নিয়ে, আর তার চেয়েও বেশি এর চিহ্ন নিয়ে৤ কোথায় "ি" হবে আর কোথায় "ী" হবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে না হলে মাথা ব্যথা অর্ধেক সেরে যেত৤ এই অনস্তিত্বের "ঈ/ ী" বর্জন করলেই বানান ভুলের তর্জন অনেকটাই কমে যাবে৤ আমরা দুই নৌকোয় পা দিয়ে সুখে চলতে চাই, কিন্তু তা হবার নয়৤ সুখে চলা হতে পারত যদি 'ঈ' ধ্বনি বাংলায় থাকত৤ যেমন ধরি, 'কাকার বাড়ি', আর 'খা-খা রোদ'-- এখানে "ক" এবং "খ" নিয়ে দ্বিধা হবে না৤ কারণ 'ক' এবং 'খ' ধ্বনিদুটি স্পষ্ট এবং আলাদা, কিন্তু-- নিতি/নীতী/নীতি/নিতী লেখায় কোনও স্পষ্টতা নেই৤ নেই কারণ এখানে ধ্বনির পার্থক্য আমরা করি না৤ আর তা না করলে বানানে কেবল নির্দেশ দানে শুদ্ধির কাজটা নিপাট হবে না৤

        ই/ঈ, ি/ী --এর একটি রেখে, অন্যটি বর্জন করলে লোকসানের দায় কাটিয়ে লাভের মুখ দেখা যাবে৤ তাই কেবল "ই" হাতে থাক, 'ঈ' দূরে যাক৤ 'ঈ' আমাদের হিসেবের খাতায় কেবল লোকসান বাড়াচ্ছে৤

        যেহেতু কেবলমাত্র লিপির ছবি কোনও ধ্বনি বহন করে না, যতক্ষণ আমরা তাকে ধ্বনি জুগিয়ে বর্ণ করে না তুলি, তাই "ি/ী"-এই দুটির মধ্যে 'ি' বর্জন করে "ী" বজায় রাখা হবে৤ লেখায় "ী" চিহ্ন(ই-এর স্বরচিহ্ন হিসেবে৤ "ি" চিহ্নের বদলে) ব্যবহারিকভাবে সুবিধেজনক, আর তা ছাড়া, "ী" চিহ্ন যেখানে যুক্ত হচ্ছে সেই সহযোগী ব্যঞ্জনবর্ণের পরেই কিন্তু এই স্বরধ্বনিটির উচ্চারণ হয়৤ 'ি' চিহ্নের মতো অদ্ভুতভাবে তা ব্যঞ্জনবর্ণের আগে বসিয়ে পরে উচ্চারণ করার দায় থাকে না৤

        শুধু এইটুকু সংস্কারই চলুক, বিশ বছর আর কিছু নয়, তখন দেখা যাবে বানানে ভুলটা আগের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে(৮.০৪৩৯%শতাংশ৤ হিসেব করে দেখা গেছে বাংলায় বানান ভুলের সাধারণ আশংকা মোট প্রায় ৩১.৭৬% শতাংশ৤ অর্থাৎ কেবলমাত্র ই/ঈ, ি/ী উদ্যোগে ভুলটা কমবে মোট ভুলের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ, তথা ২৫%শতাংশ৤ অর্থাৎ লোকসান কাটিয়ে ২৫%শতাংশ প্রফিট!)৤ তারপরে অন্যত্র হাত দেবার চিন্তা করা যাবে৤ তবে সামগ্রিক পরিকল্পনাটা শুরুতেই করে নিতে হবে৤ দিন আনি দিন খাই নীতি নয়, নিয়মিত আয় নিয়মিত খাওয়া-- এটাই হবে নীতি৤ আগে সামগ্রিক পরিকল্পনাটা তো কেউ পেশ করুন, সেখানে বলতে হবে কোন্‌টার পরে কোন্‌টা ধরে সংস্কারের কাজ এগোবে, একটার কতদিন পরে অন্য সংস্কারে হাত দেওয়া হবে৤ নইলে একবারে সব বর্জ্যলিপি বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে ভাষাটাও উড়ে যাবে যে!  

        'ই' রেখে এবং ই-এর চিহ্ন হিসেবে "ী" ব্যবহার করে দেখা যাক তা কেমন দেখতে হয়৤ প্রথম দিকে তা অনভ্যস্ত চোখে খারাপ লাগবে, পরে সেটাই অনায়াস হয়ে উঠবে৤ রবীন্দ্রনাথের কথাই একটু তেমন করে লিখে দেখা যাক--

"একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দীতে ইচ্ছা হয় না৤ কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশী৤ ...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে৤ যেটা বরাবর করীয়া আসীয়াছী সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনীলে রাগ হয়৤ মতের অনৈক্যে রাগারাগী হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার৤... যাঁরা ইংরাজী শীখীয়া মানুষ হইয়াছেন, তাঁরা বাংলা শীখীয়া মানুষ হইবার প্রস্তাব শুনীলেই যে উদ্ধত হইয়া ওঠেন, মূলে তার অহংকার৤"


        সন্ত্রাসের বীহ্বলতা নীজেরে অপমান
       সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রীয়মাণ-- আ! আহা!
                  মুক্ত করো ভয়,
আপনা-মাঝে শক্তী ধরো, নীজেরে করো জয়-- আ! আহা!
                                                --চীত্রাঙ্গদা

        কম্পিউটারে ইংরেজিতে কিছু টেক্সট লিখলে শব্দের বানান ভুল হলে অমনি শব্দটির তলায় লাল দাগ পড়ে৤ লেখককে সচেতন করে দেয় সেটি ঠিক করে নেবার জন্য৤ সেই অনুযায়ী তা ঠিক করে নিলে বানানে সমস্যা থাকে না৤ তাই বেশ নিশ্চিন্ত মনে লেখা যায়৤ ভুল ধরার ব্যবস্থা তো ওৎ পেতে বসেই আছে৤ বাংলায় কিন্তু তেমন কিছু নেই৤ নেই মানে বাংলায় তেমন সফ্‌টওয়্যার-দক্ষ লোক নেই যে এটা করতে পারে-- ঘটনা কিন্তু তা নয়, ঘটনা হল বাংলা বানানের তো কোনও নির্দিষ্ট নিখুঁত বানানই নেই, তাহলে কেমন করে কীসের ভিত্তিতে সেই কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার বানানো হবে? কম্পিউটার জগতের অগ্রগতিও অনেকটা আটকে দিচ্ছে বাংলা বানানের বিভ্রম৤

        বাংলা হরফব্যবস্থা হল কম্পিউটারের ভাষায়-- কমপ্লেক্স স্ক্রিপ্ট৤ কারণ হরফের চারিদিক ঘিরে চিহ্ন বসে-- বাঁয়ে, ডাইনে, উপরে, নিচে৤ যেমন "ি" চিহ্নের ধ্বনি বা উচ্চারণ-- সহযোগী ব্যঞ্জনের পরে হলেও তা বসাতে হয় সহযোগী ব্যঞ্জনের আগে৤ দশটি স্বরচিহ্ন বসাবার জায়গা নইলে কোথায় পাওয়া যাবে? আর আছে সাতটি ফলার মোট আটটি চিহ্ন(র-এর রেফ এবং র-ফলা দুটি ধরে)৤ এছাড়া আরও প্রায় ৩৯৫টি যুক্তবর্ণের অনেকগুলিরই মণ্ড রূপের ধাক্কা সামলে বাংলা লেখা প্রায় বিধ্বস্ত! কিন্তু 'অবৈজ্ঞানিক' না হয়ে একটু বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা করলে এর সুরাহা হতে পারে৤ কিন্তু কে করে? তার চেয়েও বড় কথা কে কাকে মানে, কে কার কথা শোনেৼ 

        আর সেই জটিলতা কেবলই যে হরফে তা নয়, তা প্রবলভাবে বিরাজিত বাংলা বানানেও৤ অথচ সঠিক উদ্যোগ নিলে তা মেটানো যেত অনেক আগেই৤ 
        বিভ্রম যে আরও আছে৤ বাংলায় একটা নির্দিষ্ট কম্পিউটার কিবোর্ড অবধি নেই৤ ইংরেজিতে কিন্তু সারা বিশ্বে একটাই কিবোর্ড৤ বাংলাদেশে একজনের ডিজাইন করা বাংলা-কিবোর্ড অন্যজনে ব্যবহার করছে কিনা তা নিয়ে প্রবল বিতণ্ডা দেখা দিয়েছিল৤

        বাংলায় কম্পিউটারের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ইউনিকোড ফন্ট চালু হয়েছে৤ এটার যে অমিত সুবিধা তার অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে নির্দিষ্ট কম্পিউটার কিবোর্ড না থাকায়৤ আগে নন-ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার সময়ে যে যার সুবিধে মতো ফন্টের কোড ব্যবহার করতে পারত, এবং করতও৤ পরে সেই "সুবিধা" রদ হল ইউনিকোডে এসে৤ ইউনিকোড একদম সুনির্দিষ্ট, ফন্ট কোডের কোনও পরিবর্তন কখনও করা চলবে না৤ ফলে তা সম্পূর্ণ শৃঙ্খলার জগতে এসে গেল৤ যিনিই বাংলা কম্পিউটার ফন্ট তৈরি করুন তাঁকেই সেই সুনির্দিষ্ট কোড মানতে হবে, কারণ এটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা৤

        বাংলা ফন্টের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা এলেও বাংলা কিবোর্ডের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঘটল না, যার জন্য বাংলা কিবোর্ডের নৈরাজ্য বাংলা ইউনিকোড ফন্টের বিপুল সুবিধাও অনেকটা ব্যাহত করেছে৤ বাংলা কম্পিউটার কিবোর্ড নিয়ে বসতে হবে সবাই মিলে, এবং একটা সুনির্দিষ্ট কিবোর্ড তৈরি করতে হবে, যে কিবোর্ড সবাই ব্যবহার করবে৤ বাংলা বানানেও তেমনি সবাই একত্রে বসে বাংলা বানানেরও একটা সুনির্দিষ্ট নীতি ঠিক করতে হবে, নইলে "আমরা সবাই রাজা"র রাজত্ব কখনও ঘুচবে না৤ বঙ্গদেশ কি আর এমনি এমনি রঙ্গে ভরা? বঙ্গবাসীর যেন কোনও কিছুই স্পষ্ট নির্দিষ্ট নয়৤ সর্বত্র 'এ্যাও হয় অও হয়' গোছের ব্যাপার৤

        হয়তো আলোচনা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে৤ সমস্যার জট খুলবে না৤ তার কারণ হয়তো সেই প্রণিধানযোগ্য উক্তি-- বাংলায় বিদ্যাসাগরদের বাহুল্য৤ কথায় আছে অধিকন্তু ন দোষায়৤ এখানে তা নয়৤



=== ০০ ===



        AhanLipi লিখে বা ‘অহনলিপি’ লিখে সার্চ দিলে লেখকের তৈরি 
বাংলা দ্বিতীয় প্রজন্মের অগ্রগত সর্বান্তিক ইউনিকোড ফন্টের ডাউনলোড লিংক পাওয়া যাবে৤